রাঢ়বঙ্গের শিল্পকলা পর্ব ১: বাঁকুড়ার টেরাকোটা ঘোড়া

রাঢ়বঙ্গের শিল্পকলা পর্ব ১: বাঁকুড়ার টেরাকোটা ঘোড়া

রামায়ণ কিংবা মহাভারতে ঘোড়াকে কেন্দ্র করে অনেকরকম কিংবদন্তি রয়েছে; কখনও পৌরাণিক কাহিনীতে সমুদ্র থেকে উত্থান হয় ঘোড়ার, কখনও স্বর্গ থেকে আবির্ভাব ঘটে ডানাওয়ালা ঘোড়া কিংবা পক্ষীরাজের। পৌরাণিক কাহিনী ও লোককথায় এরকম অনেক গল্পই খুঁজে পাওয়া যায়। 

তবে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ার ইতিহাস প্রায় সহস্রাব্দ পুরানো । মূলত মধ্যপ্রাচ্যের থেকেই, স্থলপথে এবং জলপথের মাধ্যমে, এদেশে ঘোড়ার আগমন বলে জানা যায়। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের সাথে সাথে ঘোড়ার আগমন ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের বেশ কিছু ঐতিহাসিক নথি পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে, ঘোড়াগুলি যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তীকালে তা পরিবহনের এক দ্রুততর মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বড়ো বড়ো রাজারাজড়াদের যুগে হাতিশালে শয়ে শয়ে হাতি, ঘোড়াশালে শয়ে শয়ে ঘোড়া থাকাকে শৌর্য্য-বীর্যের প্রতীক বলে মনে করা হতো। এর অন্যথা হয়নি বাংলার বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের ক্ষেত্রেও….হাতি, ঘোড়ার প্রাচুর্য্য তখনই দেখে বাংলার অধিবাসীরা। সেই থেকেই সম্ভবত অনুপ্রেরণা পান বিষ্ণুপুরে মৃৎশিল্পীরা। এই মল্ল রাজাদের শিল্পের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন পাওয়া যায় টেরাকোটা শিল্পের মাধ্যমে। রাঢ়বঙ্গের জেলা বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রাম ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে টেরাকোটা শিল্পের পীঠস্থান। টেরাকোটার মন্দিরের পাশাপাশি মৃৎশিল্পীরা হাতের কৌশলে হাতি, ঘোড়া সহ বিভিন্ন মূর্তিও তৈরি করতে শুরু করেন।

রাজাদের যুগ হয়তো গেছে কিন্তু রয়ে গেছে, আমাদের রাজ্য তো বটেই বরং বলা ভালো আমাদের দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকলা টেরাকোটা। এই টেরাকোটা শিল্পের এক অঙ্গ হিসেবে বাঁকুড়ার ঘোড়ার বিশ্বমানের খ্যাতিলাভ নিজের মধ্যেই এক অনন্য গল্প। বরাবরই বাঁকুড়ার ঘোড়ার বিশেষত্ব এর লম্বা গলা। শুরুর দিকে খুব সাধারণ চেহারার থাকলেও সময়ের সাথে সাথে এর রূপ ও সাজসজ্জার পরিবর্তন বেশ চোখে পড়ার মতো।

গ্রামে গ্রামে মা মনসা কিংবা মা শীতলা, ধর্মরাজের থানে আজও দেখা মেলে এই ঘোড়ার। লোককথা এবং ধর্মবিশ্বাসে আজও গ্রামের মানুষ দেবতার থানে মানত করে ঘোড়া উৎসর্গ করে থাকেন, তবে এই ঘোড়ার বেশভূষাও খুবই সাধারণ। কিন্তু ক্রমে ক্রমে টেরাকোটার ঘোড়া বেশ খ্যাতি লাভ করায় গৃহসজ্জায় এর চাহিদা বাড়তে থাকে। মৃৎশিল্পীরাও চাহিদার সাথে সাথে যোগান দিতে গিয়ে তৈরি করতে শুরু করেন বিভিন্ন রকমের পোড়ামাটির ঘোড়া। এর রকমফের দেখা যায় মূলত ঘোড়ার গায়ের রং চেহারার কারুকার্য ও নকশার ভিত্তিতে। পিঠে ও গলার কাছের নকশা ও ঝালর আরো সুদৃশ্য করে তোলে ঘোড়াকে। গায়ের রঙ বলতে মূলত মেটে রঙ ও কালো রঙেরই ঘোড়া তৈরি হয় এখনও পাঁচমুড়ার গ্রামে। প্রচলিত ঘোড়ার পাশাপাশি কথাকলি ঘোড়া, ঝুমুর ঘোড়াও সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ৪-৫ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৫-৬ ফুট সাইজের বিশালাকৃতির ঘোড়াও তৈরি করেন শিল্পীরা।

এই ঘোড়া তৈরীর পদ্ধতিও বেশ অন্যরকম। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ আলাদা আলাদা করে তৈরি করে নিয়ে একত্রে মাটি দিয়ে জোড়া লাগিয়ে, রোদে শুকিয়ে, ভাটিতে পুড়িয়ে শক্ত করে তবে প্রস্তুত হয় পোড়ামাটি এই ঘোড়া। একদিনে কিন্তু মোটেই তৈরি হয়ে যায় না এই ঘোড়া, নির্দিষ্ট সময় মেনে সম্পূর্ণ ভাবে শিল্পীর হাতের গুণে তৈরি হয়। কালো রং আনার জন্য ঘোড়াকে ভাটিতে দুবার পোড়ান কুম্ভকাররা।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সরকারের উদ্যোগে এই পোড়ামাটির ঘোড়া লাভ করে বিভিন্ন স্বীকৃতি। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা All India Handicrafts Board-এর Logo তেও দেখা যায় বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া। এছাড়াও 2018 সালে এটি Geographical Indication of Goods (Registration and Protection) Act, 1999 অনুসারে Geographical Indication Tag ও লাভ করে।

এরপর থেকে দেশে বিদেশে GI Tagged Artifact হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে আমাদের রাজ্যের পোড়ামাটির ঘোড়া। শুধু শিল্পই যে স্বীকৃতি পায় এমনটাও নয়…শিল্পের স্বীকৃতি আসে শিল্পীর হাতের গুণেই। পাঁচমুড়া গ্রামের শিল্পী পরিবারের অনেকেই জাতীয় ও রাজ্য স্তরে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত যেমন, রাসবিহারী কুম্ভকার, পশুপতি কুম্ভকার, তারকনাথ কুম্ভকার, বৈদ্যনাথ কুম্ভকার, ভূতনাথ কুম্ভকার সহ আরো অনেকেই।

আজও বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রামের ৫০ থেকে ৬০ টি পরিবার জীবিকা নির্বাহ করেন শুধুমাত্র এই টেরাকোটার products বানিয়ে এবং বিক্রি করে। শুধু দেশেই নয় বিদেশে ও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে পোড়ামাটির ঘোড়া সহ বিভিন্ন সামগ্রীর। বংশানুক্রমিক ভাবে এই শিল্প ধারাকে তাঁরা ধরে রেখেছেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেও শেখাচ্ছেন হাতে ধরে। তার জন্যই সম্ভব হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পধারাকে বাঁচিয়ে রাখা। 

বাংলা ও বাঙালির তথা এই দেশের এক অন্যতম গর্বের শিল্প হল এই টেরাকোটা। আমাদেরকে নিজ উদ্যোগে সচেষ্ট হয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলা ও বাঙালির শিল্প সংস্কৃতির এই নিদর্শনকে। “আমার মাটি” কিছুটা সেই উদ্যোগেই কাজ করে। “আমার মাটি”র উদ্দেশ্য হল বাংলার শিল্পসৃষ্টিকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যাওয়া এবং শিল্পীদের পরিশ্রমের যথাযথ সম্মান দিয়ে তাদের সৃষ্টিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Whatsapp icon
×
Your Cart
Cart is empty.
Fill your cart with amazing items
Shop Now
Inclusive of all taxes. You can apply coupon during checkout
0
Keep Shopping